\\ এক\\
'... এইখানে আসি গর্বডারে কবর দিবার...'
এই কথা শোনার পর তার প্রতি মনোযোগটা বেড়ে যায়। যদিও তখনও জানি না কি তার গর্ব। জীবনের শেষ সীমানায় পরপারের সাথে গড়ে ওঠা বিভেদ দেয়াল ঘেঁষে চলছে তার জীবন। সাদা এলোমেলো দাড়ি। আভিজাত্যের মাঝে বসবাস করলে এই দাড়িটাই হয়তো বেশ পরিপাটি হত। চেহারায় নূরানী একটা ভাব চলে আসত। পোষাকে দু্যতির স্পষ্ট চিহ্ন থাকত। এসব নেই, তার মানে লোকটি তথাকথিত বিত্তবান নয়। বয়স, অভিজ্ঞতা, কথা এবং নাতিদীর্ঘ ফতুয়া ও লুঙ্গি ঠিক তার দারিদ্রতার লেভেলটাও আমাকে সহজে বুঝতে দিলনা। কথায় তার দক্ষিনাঞ্চলের টুকরো টুকরো টান এবং ঢাকার প্রচলিত নিম্নবিত্তের ভাষার মিশ্র ছাপ। আমি ঠিক ভাষা বিষয়ে অতটা অভিজ্ঞ নয় তবুও যশোরে পৈতৃক বসতবাড়ি হওয়ায় ঐ অঞ্চলের ভাষার টানটা মেমোরিতে স্থান নিয়ে আছে।
দশ পনের মিনিটের বেশি হবে দুজনেই খুব কাছাকাছি বসে ছিলাম। সম্পর্ূণ অজ্ঞাত দুজন মানুষ ছিলাম আমরা। নিজের মাঝেই নিমগ্ন অসম বয়সী দুজন পুরুষ। কেউ কাউকে আকর্ষন করা মত কোন কারন ছিলনা। লোকটা কাছাকাছি ঘাসের উপর বসে ছিল। আমি ইদানিংকালে এই পার্কে নির্মিত অগভীর লেকটার পশ্চিম পাড়ে ঢালাই টুলে বসে ছিলাম। চারদিকে তাকিয়ে দেখছিলাম। সেটা বারবারই। একেবারে যে আসা হয়নি এখানে তা নয়। তবে একা নয় অবশ্যই। তা সে যাকেই নিয়ে আসি না কেনো, সে রমনী বা শুধুই বন্ধু সে বিষয় এখানে কোন আলাদা ব্যঞ্জনা জাগাবে না। তবে আমার এক বন্ধু আছে সে প্রায়ই আসে এখানে। ঘাসে বসে, কখনও শুয়ে পড়ে শক্ত ইটের শুকনো কোন প্রান্তরে। স্মৃতি স্তম্ভের দেয়াল ঘেঁষে আসন গাড়ে। সে কবি। তার মন খোলে। প্রাণ দোলে। সে জীবনের মুক্তি খোঁজে এবং নির্ঘাত অকপটে ক্লাস ফাঁকির কাজটাও করে। আজ আমিও তাই করতে এসেছিলাম। মনটা ভাল ছিল না। বিশাল গর্বের পাহাড়সম বোধটা মন থেকে খসে পড়তে পড়তে সমতল হয়ে যাওয়ার উপক্রম। মনের বিরুদ্ধচারণ করে ঢাবির ঐ ফার্মেসির ক্লাশ আর কত!
পূর্ব থেকে পশ্চিমগামী সূর্যটা টগবগে যৌবন উদ্দীপ্ত। পকেট থেকে দিনের জন্য বরাদ্দ তৃতীয় বেনসনটা বের করে ধরাতে চাচ্ছিলাম। সিগারেট কমানোর ক্রম একটা প্রচেষ্টায় রত আজকাল। বিশটা থেকে কমাতে কমাতে এখন দিনে চারটা বরাদ্দ। সকালে ভার্সিটি এসে আটাশ টাকা খরচ করে চারটে একেবারে কিনে নেই। তারপর সকাল দুপুর বিকেল ও রাত। আজ ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ভার্সিটি ছেড়ে সোহরাওয়ার্দি পার্কে ঢুকতে ঢুকতেই দুটো শেষ হয়ে গেছে। তৃতীয়টি এখন পোড়াতে যাব কিন্তু পকেট হাতড়ে ম্যাচটা খুঁজে পেলাম না। খুব কাছেই সস্তা সিগারেটের কড়া গন্ধ নাকে আসতেই লোকটার দিকে তাকালাম। আমার অবস্থান থেকে বাম দিকে বসে ছিলেন। মুখে ধবধবে সাদা একটা সিগারেট সবে জ্বলতে শুরু করেছে। ইটের টুলে বসেই লোকটাকে বললাম, 'চাচা, একটু আগুনটা দেয়া যাবে।' বলেই আমি উঠে হাত বাড়াতে যাচ্ছিলাম তার আগেই তিনি উঠে আমার কাছে এগিয়ে এসে সিগারেটটা বাড়িয়ে দিলেন। নেভি সিগারেট। হাত থেকে নিয়ে বেনসেনটা ধরাচ্ছি। বেনসনের স্বাদ নেভির মত হয়ে যাচ্ছে টের পাচ্ছি। তখনই লোকটা কথা বলতে শুরু করল। তিনি আমাকে স্কুল ছাত্র মনে করেছেন। দাড়ি গোফ ডবল সেভে কামানো থাকলে সেদিন আমাকে একটু কিশোর কিশোর লাগে বৈকি। তাই বলে স্কুল ছাত্র!। বললেন, 'কিছু মনে না করলি এট্টা কথা বলতি চাইলাম; বাবজান, আপনে কি স্কুলি পড়েন? এখন থেকেই সিগারেট ধরিছেন?
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। উনি আবার বলেন, 'না বাবজান, গ্রামে আমরাও হেই ছোডকালে চাচাগো লগে হাটে যাতাম, হুক্কার তামাক সাজাতি সাজাতি সিগারেট খাওয়া শিখা গেছি। কিন্তু এখনও গ্রামের ছোট কেউ আমাগো মুরুব্বীগো সামনি সিগারেট খায়না তাই যত বড়ো মেম্বার টেম্বারই হউক না কেন। গ্রাম, সে তো আমাগো সমাজ। আবার আমারে ভুল বুইঝেন না। আপনি আরাম কইরে টানেন। আমি বুঝি। আপনারাও নিশ্চিত আপনাগো সমাজে মুরুব্বীর সামনে খান না। অনেক ঠেইক্কা এইসব শিখছি, সমাজ ছোট ছোট গন্ডিতে আলাদা হুয়েছে। এক সমাজের লগে আরেক সমাজ মিলাইলে হইব!'
বিরক্ত লাগছিল। তবুও বলে ফেললাম, 'না চাচা আমি ভার্সিটিতে পড়ি। মনটা ভালো না তাই সময়টা কাটাতে এইখানে এসে বসেছি।'
উনি কথা বলতে বলতে কখন পাশের ইটের টুলে বসে পড়েছেন খেয়াল করিনি। এখন দেখলাম। বললাম, 'চাচা এই নেন আপনাকেও মুরুব্বী মানলাম, ফেলে দিচ্ছি।'
'বাবা আপনি আমারে কি ভুল বুঝতিছেন ? আমি মুখ্কু মানুষ কি বলতে কি বলি ফেলিছি। আপনি সিগারেট টানেন। এই জায়গা সমাজির বাইরে। এইটা উদাম পার্ক। এহানের আইনই আলাদা। তা বাবজান, মনে হতিছে আপনার মনটা খুব খারাপ ?'
আমি সিগারেট আর ফেললাম না। ভাবছিলাম উনি এত বেশি কথা বলছেন কেনো। আবার শুরু করলেন, 'বাবজান, এই যে বদঅভ্যাস, এই সিগারেট আমরাই তো আপনাগো শিখাচ্ছি খাতি। আমরা খাইছি। আপনারা শিখছেন। আপনারা খাইবেন আপনাগো পোলাপান শিখব। থামব কখন, যখন কোন একটা দল বন্ধ করবেনে কেবল তখন। কঠিন সব কঠিন। দেহ্যান সেই মহা পরিবর্তন আনতি চালাম, আনলাম , তারপর এমন পরবির্তন হুয়ে গেলো যা নষ্ট কইরা দিল সব।'
এবার উনি থামলেন। আমিও হু হু বলে সিগারেটটাতে লম্বা টান দিয়েই ফেলে দিলাম। উনি হাসলেন।
বললাম, 'ঠিক বলেছেন, কোন একটা জেনারেশনকে অবশ্যই বদলাতে হবে। কিন্তু সেই বলির পাঠাটা কারা হবে? আচ্ছা আপনি কি করেন? রোজ এখানে বসে থাকেন, উপদেশ বিলি করেন? এটাই কি আপনার কাজ?' বলেই মনে হলো বলা ঠিক হলো না।
উনি অবশ্য উত্তর দিলেন। ওনার উত্তরের সেউ গর্বটা কি আমার জানতে বড্ড সাধ হলো।
\\দুই\\
আগ্রহ বাড়ায় আলাপ আরও দীর্ঘ হতে লাগল। ওনার কথা অনুযায়ী জানলাম আমাকে কোন কারনে ওনার খুব পছন্দ হয়েছে সে কারনেই এত কথা বলছেন। না হলে নিশ্চুপ জীবন স্মৃতির পাতাগুলো উল্টে উল্টই তিনি পার করেন পার্কের নিরবকাল।
আমি ওনার সেই কবর দেয়ার সাধতুল্য গর্বটি জানার আগ্রহে জিজ্ঞেস করার পর তার মৃদু কণ্ঠের উচ্চারনে জানলাম উনি দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন। ওনাদের সেই যুদ্ধের কারনেইে আজ আমরা মুক্ত। উনি একজন মহান মুক্তিযোদ্ধা।
একটু আগেও ভাবছিলাম আজ দিনটা কত খারাপ। সকাল থেকে কেবল খারাপ খারাপ ঘটনা ঘটেই চলেছে। কিন্তু এখন আর তা মনে হচ্ছে না। আমার সাথে একজন মুক্তিযোদ্ধা বসে আছেন। আমি কল্পনায় ভাসি। উনি অস্ত্র হাতে সেই ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ আমার কাছে বরাবরই এক বিশাল কল্পনার বিস্তৃত স্বপ্নীল আলোড়ন। বুদ্ধি হবার পর কাছাকাছি কখনও কোন মুক্তিযোদ্ধাকে পাইনি। কেবল পড়েছি আর দেখেছি অসম্পূর্ণ নাটক সিনেমায়। বাবার সেজ চাচা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। সে দাদু বীর প্রতীক পদকও পেয়েছেন। ওনাদের ঘরে বড় করে তার ছবি টানানো। গায়ে আর্মির জংলী ছাপ পোষাক। পাশে বাঁধানো মুক্তিযোদ্ধার সনদ। আমার ছোটকালেই উনি মারা গেছেন। উনার কোন স্মৃতি মনে পড়ে না। কিন্তু মুগ্ধ হই যখন শুনি এখনও ওনার নাম স্মরন হয় পারিবারিক কোন পার্টি বা অনুষ্ঠানে কিংবা টিভির সংবাদে। কিন্তু উনি তো ননসিভিলিয়ান। আর এই মুহুর্তে আমার সম্মুখে একজন পোড় খাওয়া সিভিলিয়ান মুক্তিযোদ্ধা। আমি গর্ববোধ করতে শুরু করি। অনেক কথা বলার ইচ্ছে জাগ প্রাণে। আমি অবাক হই। যে মুুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ওনার এমন ঐশ্বর্যময় গর্ব সেই গর্বে আজ এই ভারাক্রান্ত জীবন সায়াহ্নে উনি এত কুণ্ঠিত কেনো, কেনো গর্বের কবর দিতে চান? আমি প্রশ্ন করি।
উনি হাসেন। বলেন, 'বাবজান অবুঝ হয়ে উঠিছি আজ আমরা, বুঝিনা যুদ্ধটা ভুল ছিল, না ভুল আছিল গর্বডা, নাকি দুইটাই। '
আমি ওনাকে তুমি করে বলতে বলি। উনি আবারও হাসে। আমি উঠে বলি, 'আপনাকে একটু কদমবুসি করি।' বলেই আমি মাথাটা নিচু করতে থাকি। উনি বলেন, 'আর গর্ব বাড়াইও না, গর্বটা মরলি শেষ ক'টা দিন একটু শান্তিতে কাটাইতি পারতাম।' উনি আমাকে পায়ে হাত দিতে দেন না। ওনার চোখে পানি চলে আসে।
বোকার মত অনেকগুলো প্রশ্ন করে ফেলি। 'চাচা, আপনার যুদ্ধ করতে ভয় লাগত না। চাচা, আপনার সনদ আছে, বড় করে আপনার নাম লেখা। কোথায় টানিয়ে রেখেছেন।'
'বাবজান, তুমি বেশি উত্তেজিত হইতাছ। যুদ্ধ! ওতো তো বুঝি নাই ! টগবগে তরুন ছিলাম। উত্তেজনা ছিল রক্তে। হানাদার হারামীগুলা অত্যাচার করতি লাইগলো। ওদিক ডাক দিলেন প্রাণের জননেতা শেখ মুজিব । এই তো এইখানে এই ময়দানেই সেই ৭ই মার্চে সংগ্রামের ডাক দিলেন। রেডিওতে শুনিছিলাম। হানাদার মারবার লাইগ্যা ছুটলাম। তাগো তাড়াই দেলাম। কাম শেষ। সব শেষ। সনদ দিয়া কি হবেনে বাবজান। কাগুজের লাইগ্যা তো যুদ্ধ করিনাই। ...'
আমি অবাক হই। এর চেয়ে বড় গর্বের আর কি আছে। ওনার মত মানুষদের সেদিনের সেই অবর্ননীয় কষ্টের জন্য আজ আমরা এই এত ডাইমেনশনে ভাবতে পারছি। এত পেয়েও আরও পাওয়ার বাসনায় মন খারাপ করছি। ক্লাশ বাদ দিয়ে মন ভালা করতে পার্কে এসে বসেছি। এ সবই তো তাদের সেই যুদ্ধের ফল, ছিনিয়ে আনা স্বাধীনতা। কিন্তু উনি একের পর এক কেবল হতাশার কথা বলে চলেছেন। আমি অবাক হতেই থাকি।
শিখা চিরন্তন জ্বলছে একটু দূরেই। উনি দেখেছেন কিনা জানতে চাই। আবারও হেয়ালি করেন। 'বাবজান ঐ আগুণে যদি গর্বডারে পোড়াইতি পারতাম। এ বুঝলা এক আজব গর্ব । এ মরে না। এ পোড়ে না। এর কবর হতি পারেনা । '
\\তিন\\
খুব ভাল ছাত্র ছিলাম বলেই ভাবতাম। এটা আমার দীর্ঘ স্কুল জীবনে তিলে তিলে গড়ে ওঠা প্রকৃষ্ট গর্ব। এসএসসিতে জিপিএ ৫ পেলাম। নটরডেম কলেজে ভর্তি হয়ে গেলাম। গর্বর সাথে গর্ব যুক্ত হচ্ছিল। এইচএসসিতেও সেই ৫। অথচ তখথনও বুঝিনি এই জিপিএ পাঁচই তো জীবনের সব প্যাচ নয়, আরও সামনে আছে। ৫ এর ছড়াছড়ি। অথচ ইঞ্জনিয়ারীং , ডাক্তারী , বিবিএ পড়ার সুযোগ সংখ্যা তার কম। গোল্ডেন ৫ ছিল না। মেডিক্যালে পেলাম সেই সুদূর ফরিদপুর। কিন্তু ঢাকার বাইরে বাবা পড়তে দেবেন না। আমারও গর্ব পতন ঘটবে বলে ইচ্ছে করলনা। ইঞ্জিনিয়ারীংয়ে পছন্দের বিষয় পেলাম না। গর্ব কষ্ট দিতে শুরু করল। শেষ মেষ বাধ্য হয়ে পড়াশুনার কনটিনিউয়েশন রাখতে ভর্তি হলাম ঢাকা ভার্সিটর ফার্মিসিতে। কিন্তু গর্ব খোঁচাচ্ছিল। বলছিল - হলো না। এমনতো কথা ছিল না। এ দেশে অনেক কিছূ তো কথা ছিলনা হবার । তবুও হচ্ছেই । কিন্তু স্বচ্ছল পরিবারের আরাম আয়াসে মানুষ আমার মধ্যে কেনোই বা তখন সে বোধ আসবে। মা বললেন এনএসইউ বা ব্রাকে ভর্তি হতে। গর্ব বাঁধ সাধল। দূর! প্রাইভেটে পড়তে হলে বিদেশেই চলে যাব। সেই ইচ্ছেতেই নতুন স্বপ্ন দেখার শুরু হলো। চেষ্টা করতে লাগলাম। আইএলটিএস , টোফেল দুটোই চচর্া করে দিয়েও দিলাম পরীক্ষা। লেগে থাকলাম। ভর্তিও হযে গেলাম ইউএস এর এক ভার্সিটিতে। আগামী মাস থেকে ক্লাস। অথচ ভিসা নিয়ে একটু জটিলতা রয়েই গেছে। আজও দিল না। ফার্মেসি আর ভাল লাগছিল না। গর্ববোধও বিরক্ত বরছিল। ভাগ্যের উপর রাগ হচ্ছিল। সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে সবুজ গাছের ছায়ায় একটু খানি বসতে এসেছিলাম মাথায় তখন ভিসা না পাওয়ার টেনশন।
ভিসা পেলে পার্কে ঢোকা হতো না। একজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে এই দেখাটা হয়তো কোনদিনই আর হতো না। বিদেশের হাইটেকে মিশে হাই এম্বিশানে ভুলেই যেতাম মুক্তির যুদ্ধ, প্রাণের মুক্তির সেই জাগরণ ধারন করা হতো না। তখন তা প্রাণহীন কাগুজে ইতিহাস রূপেই ধরা দিত কেবল।
তার কাছ থেকেই আমি জনালাম কিভাবে একজন মুক্তিযোদ্ধার জন্য মুক্তিযুদ্ধটাই গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সেই মুক্তিযোদ্ধা হায়াত আলীই আমার মধ্যে নতুন এক গর্বের বীজ বুনে দিয়ে গেলেন। উনি আমকে তার পরিচয়ের মথ্যে কবল এই নামটাই বলেছিলন। তার তো কোন মুক্তিযুদ্ধের সনদ ছিল না। তার শহর বা গ্রামের কোন ঠিকানা জনা হয়নি।
উনি কেবল বলেছিলেন কিছু বাস্তবতা। ওনার কথাতেই জানলাম, মিষ্টি ভাষী লোকগুলোকেই আজকাল ভয় হয়, তাদের কর্মকান্ডই বেশী খারাপ লাগে। অথচ বাস্তবতা হলো এরাই বড্ড কথা বলে।
\\চার\\
যুদ্ধের সময় হায়াত আলীর বয়স ছিল তেইশ কি চবি্বশ বছর। পাশের গ্রামে যেদিন হানাদাররা হামলা করেছিল সেদিন রাতেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। তারপর নানা চড়াই উৎড়াই পাড়ি দিয়ে ওপার গিয়ে পৌঁছান। সেখানেই ট্রেনিং নেন। দেশে এসে সফল ভাবে অনেক অপাশেনের অংশ নেন। এর মধ্যে নিজ গ্রামেও আসেন । মা, বাবা একমাত্র ছোটবোন সবাইকে হানাদাররা সেই সে রাতে নিষ্টূর ভাবে হত্যা করেছিল। দশ বছর ছোট ভাইটাকে আর কোন দিন খুঁজে পাননি তিনি। কেউ রইল না আর।
দেশ স্বাধীন হবার পর গ্রামে এসে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন হায়াত আলী। কষ্টের দিন কাটছিল। পৈতৃক স্বল্প ভিটা চাষের জমি তাও সর্বস্বাকুল্যে মাত্র ১ বিঘার মত। এই সম্বল। একটা বিয়ে করে ফেললেন। সংসার চলে না। নিজের জমির সাথে সাথে অন্যর জমিতে কামলা খাটতে লাগলেন। তার জমিতে ফসল হতো একবার মাত্র। বাকী সময় পানিতে ডুবে থাকত। সেই সময় শহরে গিয়ে রিকশাও চালাতে শুরু করেন। এভাবেই চলছিল।
প্রথ প্রথম গ্রামের অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা মিলে মাঝে মাঝ বসে সভা সমিতি শুরু করেছিলো। কিন্তু সংসার আর জীবিকা এক সময় সেগুলোতে আর নিয়মিত সুধা ঢালতে দিল না ভাগ্য। বউকেই ঢাকায় নিয়ে আসলেন। কৃষিকাজ ছেড়ে রিকশা ওয়ালা বনে গেলেন পাকাপাকি। এই ঢাকাতেই তার পিঠাপিঠি দুটো ছেলের জন্ম হলো।
এরই মধ্যে দেশের রাজনৈতিক পটে অনেক পরিবর্তন হলো। জীবিকার ভাবনায় তখন সকাল শুরু আর জীবিকার টানাপোড়নে রাত শেষ। অতসক ভাবার সময় কই। কোথায় কখন মুক্তিযোদ্ধার লিস্ট তৈরী হয়েছে। কোথায় কে সনদ দিচ্ছে এসব খবর রাখার সময় কই তার।
কিন্তু একটা সময় হঠাৎ সেই টানাপোড়নের মাঝে টের পেলেন যে উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার পিছে ছুটেছিলেন তারা তার কানাকড়িও চোখে পড়ে না আজ। বরং চোখের সামনে ঢাকায় রোজ দেখেন চিহি্নত সব শয়তান কুচক্রী পাকিস্তানের দোষররা গাড়ী হাকিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হাসছে। তার খারাপ লাগার বিষয়ে গতি সঞ্চার হলো সেইখান থেকে।
একটা ঘটনা খুব পীড়া দিয়েছিল। দুপুরে মগবাজারের ডাক্তার গলিতে রিকশা থামিয়ে তিনি বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। একটা লোক এগিয়ে এসে বলল, 'আই যাবি।' যাবার জন্য হায়াত আলী মাথাটা উঁচু করে তাকাতেই ব্যাটাকে চিনতে পারলেন। যশোরের যে এলাকায় বেশী ভাগ অপারেশন চালিয়েছিলেন তিনি সেখানেই ঐ হারামজাদাকে দেখেছেন। আলবদরের বড় একনিষ্ট কর্মী ছিল ব্যাটা। যেভাবে বাংগালীদের জবাই করতো, কসাইও ফেল। ব্যাটাকে শেষের দিকে অনেক খোঁজা হয়েছে। পাওয়া যায়নি। চোখের সামনে দেখেছে কত নারীরে ধরে ধরে পাক আর্মিদের ক্যাম্পে দিয়ে এসেছে। এমন একটা ক্যাম্প থেকে একবার একসাথে ৪৭জন বিভিন্ন বয়সের নারীকে উদ্ধার করেছিলেন তারা এক অপারেশেনে গিয়ে।
পার্কের ভেতরের পুকুর টাতে গোসল করে ঘুমায় রোজ বেশ কিছু কিশোরী আর যুবতী। সারারাতে খদ্দেরের লালসার বিষ ঝেড়ে সকাল রোদের পরশে শান্তির ঘুম। এদের এই নিকৃষ্ট জীবন দেখে হায়াত আলী আজকাল খুব ভাবেন সেই ৪৭জন নারীর কথা। সবাই তারা কেমন আছ কোন খোঁজ কোথাও পান না তনি।
...রাজাকর ব্যাটাওে দেখে তিনি যেতে নারাজ হন। ইচ্ছে হয় ব্যাটার গলার টুটিটা চেপে ধরে শেষে করে দিতে। কিন্তু এখন তো যুদ্ধ নেই। মুক্তিযোদ্ধারাতো যুদ্ধের পরে মানুষ হত্যা করে না। এমনই তো হায়াত আলী জানে। 'না' শুনে হারামী ব্যাটা ক্ষ্যাপে ওঠে। তারপরই একটা ঠাস শব্দ হয়। সে অপমান কখনও ভোলার নয়। ঢাকা ছেড়ে বউ বাচ্চা নিয়ে গ্রামে ফিরে যান তিনি আবার। সেখানের অবস্থাও ভালো ছিল না। ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হয়েছে যিনি তিনিও মুক্তিযুদ্ধের সময় পিস কমিটির সদস্য ছিলো। এসব কি হচ্ছে ভেবে পায়না একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
পরিচিত দু'একজন বন্ধু মুক্তিযোদ্ধার সাথে আবার মিলন হয়। তারা মুক্তিযোদ্ধা সংসদে তাকে যেতে বলে। সনদ সংগ্রহ করতে বলে। সনদ ! সনদ দিয়ে কি হবে সে প্রথমে ভেবে পায় না। সুহৃদ বন্ধূরা বোঝায়, অনেক লাভ। লাভের জন্য কিংবা বন্ধুদের জেদেই মুক্তিযোদ্ধার লিস্টে নাম উঠোনোর জন্য তিনি যান। গিয়ে দেখেন লিস্টে প্রথম নামটাই তাদের বর্তমান চেয়ারম্যান সাহেবের্। দ্বিতীয় জন চেয়ারম্যানেরই সাথের আরেক চিহি্নত রাজাকার। ঐ সব লোকদের সাথে একসাথে এক লিস্টে কেনো নাম তুলবেন তিনি ভেবে পান না। তিনি আর কখনও নাম ওঠানো চেষ্টাই করেন না। যে মা, মাটির জন্য লড়েছেন সেই মাটির বুকে সোনার ফসল ফলানো মহান কাজেই নিরব নিয়োজিত থেকে বুকে জমা ছাই চাপা কষ্ট নিয়ে কোনমতে বাঁচতে চেষ্টা করেন।
ছেলেরা বড় হয়ে ওঠে একমসময। ছোট ছেলেটা মেট্রিক পাস করে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটাতে একটা চাকুরীর আবেদন করে। সবাই বলে মুক্তিযোদ্ধার ছেলে চাকুরী হয়ে যাবে। চাকুরী হয় নাই। ছেলের বাবার তো সার্টিফিকেটই ছিল না। কাগজের গুরুত্ব বাস্তবতার গুরত্বের চেয়ে বেশী, ভীষর অবাক কান্ড! তিনি ভেঙে পড়েন। ওদিকে বড় ছেলেটা চেয়ারম্যানের ছেলের চামচা হয়ে উঠেছে। যেদিন জানলেন সহ্য আর করতে পারছিলেন না। কিছূ বলতে পারেন না। অন্তর দূর্বল হয়ে গেছে ভীষল। এর ক' মাস পর বউটাও ক্যান্সারে মারা গেলো। মারা যাবার আগে অন্তত দুই ছেলে বিয়ে করিয়ে যেতে পেরেছেন তাদের মা।
ছেলের বউরা ঠিকমতো দেখাশোনা করে না। শেষে তিনি একা একা আবার শহরেই চলে এলেন। আবার বনে গেলেন সেই পুরাতন রিকশা চালক।
একদিন হঠাৎ ছোট ছেলে ঢাকায় এল। চবি্বশ হাজার টাকা নিয়ে এসেছিল তার জন্য। জানাল তার সেই একবিঘা জমি তারা বেচে দিয়েছে। তিনি এবার আর বিস্মিত হলেন না। তার নামে জমি। ছেলেরা তার অনুপুস্থিতিতেও বেচে ফেলল। তিনি বুঝে গেছেন স্বাধীন দেশে তো। এখানে সবই সম্ভব। এ হলো সব সম্ভবের দেশ।
খুব কষ্টে দিন কাটছিল। বয়সও বেড়েছে। টাকাটা তিনি নিলেন। ধরে নিলেন সেটা চিরকালে ছেলেদুটোর সাথে বিচ্ছিন্ন্ হবার মূল্য। সেই টাকা দিয়ে তিনি দুটো রিকশা কিনলেন। একট নিজে চালাতেন আর একটা ভাড়া দিতেন। আর অবসর সময়ে পার্কে বসে ভাবতেন গর্বডারে কবর দিতে পারলে আজ এই নিঃস্ব হওয়া লাগতো না। ছেলেরাও তাড়িয়ে দিতনা।
\\ পাঁচ\\
বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়াত আলীর সাথে এই পার্কে আমার মোট তিন দিন দেখা হয়েছিল। উনি প্রায় প্রতিদিনই আসতেন। রিকশা চালাতে পারতেন না আর। ভাড়া দিতেন দুটো রিকশাই। যা আসত তা দিয়েইি বস্তির ঘরভাড়া আর খাওয়া হয়ে যেত।
একটা প্রশ্ন করেছিলেন আমাকে 'বাবজান, দেশ স্বাধীন হইয়া কাগো লাভ হুয়েছ বলো দেখি?'
আমি কিছু না ভেবেই বলেছিলাম, 'এই তো আমাদের সবার। সব বাংগালীর।'
উনি হো হো করে হেসে উঠেছিলেন। বললেন, 'নাগো, না। ঐ রাজাকার আলবদর ছিল যারা হেগোই সবচেয়ে লাভ হৈছে। কেমনে জানো। যদি দেশ স্বাধীন না হইত তাহলি তো হেরা থাইকত পাকিস্তানের চাকর বাকর বা চামচা হুয়েই। আর এখন দেখতি পাচ্ছ হেরা দেশের মন্ত্রী মিনিষ্টারও হুয়ে গেছে। এত আরাম কি দেশ স্বাধীন না হৈলে পাইত। পকিস্তানীরা এগোরে দিয়ে তো কেবল কামই করাইত। ...'
এরপর আর উনি হাসে নি। আমি জানি ওটা ওনার মনে কথা ছিল না। ক্ষোভের কথা ছিল। দূর্বলতার কষ্ট ছিল। সিগারেটটা খুব বেশি টানা শুরু করেছিলেন জীবনের শেষের দিকে। তৃতীয় দিন যখন দেখা হলো, হঠাৎ কথা বলতে বলতে তার হার্টটা আক্রান্ত হলো। একজন নারী ছূটে এসেছিল। রাতে দেহের বানিজ্য শেষে বিশ্রাম নিচ্ছিল যে সকল সমাজ বঞ্চিতা, তাদেরই একজন। নারীটিকে একদিন দেখেছিলাম হায়াত আলীর কাছ থেকে একটা সিগারেট চেয়ে নিতে। তিনি দিয়েওছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা হায়াত আলীর সাথে তিন দিনের দেখায় ঐ সব নিগৃহ নারীদের গঞ্জনার বিষয়েও আলাপ হয়। খুব দুঃখ নিয়ে বলতেন এ জন্যই কি স্বাধীনতা! তিনদিনের সাক্ষাতে আমরা যেন খুব কাছের দু'জন মানুষ হয়ে উঠেছিলাম।
ঐ নারীটির সহযোগিতায় আমি ওনাকে রিকশা পর্যন্ত নিয়ে যাই। তারপর দ্রুতই পৌঁছে যাই ঢাকা মেডিক্যাল। রিকশায় উঠিয়ে দিতে দিতে সেই নারী বরেছিল, ইস ! চাচা প্রেত্যেকদিন এইখানে আইসা বইসা থাকত। বড় ভালা মানুষ। আল্লাহ ওনারে বাঁচাই রাইখ্য।'
উনি আর বাঁচেন নি। ওনার লাশ পাঠানোর মত কোন ঠিকানা জানা ছিল না। উনি অবশ্য একদিন আমাকে কথায় কথায় বলেছিলেন মৃতৃ্যুর পর যদি তার লাশটাও কোন কাজে লাগত এই দেশের জন্য তবে বোধহয় গর্বটা চূর্ণ হত। একটু কষ্ট হলেও ওনার লাশটা মেডিক্যাল ষ্টুডেন্টের জন্য চিকিৎসা সেবার কাজে লাগনোর ব্যবস্থা করে দিতে পেরেছিলাম।
বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়াৎ আলী মারা যাবার দিন পনের পর বিদেশে যাবার আগে আরেকবার, মাত্র একবারের জন্য সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে ঢুকেছিলাম। অজান্তেই সেই দেহবণিক নারীটিকে খুঁজছিলাম। আমকে দেখেই যেন সে ছুটে এল। তাকে মৃুত্যু খবরটা দিলাম। তার চোখে পানি দেখলাম।
বেরিয়ে আসতে আসতে টের পেলাম আমার চোখেও পানি। সাথে সাথে টের পেলাম বুকের বামপাশে একটা বাড়তি চাপ। ঠিক গর্ব হলে যেমন হয়। বুকটা ফুলে ওঠে। আমার মধ্যে গর্ব স্থানান্তর হয়েছে। তিনটা দিন অনেকটা সময় আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সাথে সময় কাটিয়েছি। আমার বুকে মাথা রেখেইে পরম শান্তিতে পরপারে পাড়ি দিয়েছেন তিনি। বিদেশ বিঁভূইয়ে এই স্থানান্তরিত গর্বটাই আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু হয়ে রবে হয়তো।